বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদন অঞ্চল সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রাম। ইতিমধ্যে দেশকে ছাপিয়ে বহির্বিশ্বে দুগ্ধ রাজ্য হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের এই গ্রাম।
২০১৯ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাতক্ষীরা এস এম মোস্তফা কামাল জেয়ালা গ্রামে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে আয়োজিত এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘গ্রাম হবে শহর’ প্রকল্পের আওতায় তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামকে সাতক্ষীরা জেলার প্রথম গ্রাম হিসেবে শহরে রূপান্তর করার ঘোষণা দিয়েছেন। তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে এই উপজেলা ছোট-বড় ৪০ টির রেজিঃ কৃত গাভীর খামার আছে। বর্তমান সময়ে আরো বেশি করে খামার গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন ছয় থেকে আট হাজার এর বেশি লিটার দুধ উৎপাদন হয় এই পল্লীতে। এসব দুধ রপ্তানি হয় খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। যা প্রভাব ফেলেছে সাতক্ষীরার অর্থনীতিতে। বৃদ্ধি পেয়েছে জেলার অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির হার। এত সফলতার কারনে উপজেলার যুবকরা এখন ঝুঁকছে গাভী পালনে, গড়ে তুলছেন ছোট বড় খামার।
তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রাম একটি মিশ্রিত সাম্প্রদায়িক জনগোষ্টির মিলিত বসবাস। জেয়ালা গ্রামের ঘোষ পাড়া ঘুরে দেখা যায়, এমন কোন বাড়ি নেই যে সেখানে ৮-১০ গাভী গরু নেই। এই গ্রামে শুধু মাত্র ঘোষ সম্প্রদায়ের সংখা ১০০ পরিবার তাদের মধ্যে ৬০টি মতো বড় খামার আছে। আর সেখানে ১৫ হাজারের মতো গাভি রয়েছে।
জেয়ালা গ্রাম সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা একটি সরকারি খাল থাকায় দু পার্শ্বে বিভক্ত রয়েছে। অপর প্রান্তে চন্ডীপুর ঘোষ সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ৫০ টি। যার মধ্যে ছোট বড় বিশ টার মতো খামারে প্রায় এক হাজার গাভী আছে। গ্রামের অপর দিকে মুসলিম আর ঘোষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে গড়ে উঠেছে বড় বড় গাভী খামার। আর সেখানে উৎপাদন হচ্ছে দুগ্ধ।
মুসলিমদের প্রায় ৩০-৪০ টি খামারে ৫-৬ শত গাভী দেখা গেছে। তালা উপজেলার বিভিন্ন গাভী খামারে দেখা গেছে দেশি, সাইওয়ন, হলেষ্টন, পাঞ্জাবী, বর্তমান সময়ের জার্সি, সাইওয়ল ফ্রিজিয়ান(ভারত) সহ ক্রস জাতের গাভী পালন করেন। এত সব জাতের মধ্যে জার্সি জাতের গাভীর বেশি পরিমান দুধ হয়। এক দিনে একটি গাভী ২৮-৩০ লিটারের মতো দুধ দেয়। আবার গো খাদ্যের গুনগত মানের উপর ভিত্তি করে একই গাভীর ৩৫ লিটারের মতো দুধ হতে পারে। দেশি বিদেশী ও ক্রস জাতের গাভীর সম্মনয়ে গড়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুধ উৎপাদন কেন্দ্র তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রাম।
এই এলাকায় দিন দিন খামার বৃদ্ধির কারনেই উপজেলা সদর সহ জেয়ালা গ্রামের আসে পাশে গড়ে উঠেছে দুগ্ধ সংশোধনী কেন্দ্র। পাখিডাকা ভোরেই জেগে হাজার ব্যাস্ততায় শুরু হয় দাদা বৌদির কাজ। নারী-পুরুষ ছোটেন খামারের দিকে। শুরু করেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। গোবর সরিয়ে রাখেন নির্দিষ্ট স্থানে। মোটর (পাইপের) পানি দিয়ে গা ধোয়ানো হয় গাভী গুলো। খেতে দেওয়া হয় ঘাস-বিচালি কিংবা ভুসি, খইল সহ নানা পুষ্টিকর গো খাদ্য। দুধ দুইয়ে রাখা হয় ছোট-বড় সিলভারের কলসি কিংবা প্লাস্টিকের পাত্রে বা প্রাচীন তম টিনের হাঁড়ি কলসিতে। তার পর এসব দুধভর্তি পাত্র নিয়ে সাইকেলে পুরুষরা ছোটেন তা বিক্রি করতে চলে আসে দুধ সংশোধনীগারে।
জেয়ালা গ্রামের দুধ ব্যবসায়ীরা বলেন, দুধের ব্যবসা করতেন তারা। এটা তাদের পৈতৃক ব্যবসা। তবে আগে স্বল্প পরিসরে থাকলেও বর্তমানে তাদের খামারের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় সাড়ে ৩৭ টাকা। এছাড়া দৈনিক খরচ হয় ৬-৭ হাজার টাকা গোয়ালে গাভী হিসেবে। প্রতিদিন খরচ বাদ দিয়েও ৫ হাজার টাকার বেশি লাভ হয়।
তালার জেয়ালা গ্রামের প্রশান্ত ঘোষ শৈশব থেকে শুরু করেছেন গাভী পালন। তিনি ১৯৭৫ সালে ছয় হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করে ১ টি গাভী নিয়ে খামার শুরু করেন। এখন তার খামারে ৩৮ টি গাভী। তার প্রতিদিন তিনশত বিশ থেকে ত্রিশ লিটার দুধ হয় প্রতি লিটার ৩৫-৪০ টাকা প্রতিদিন তের থেকে চৌদ্দ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করেন বলে জানা গেছে। তার খামারে কয়েক জন পরিচ্ছন্নকর্মী ও গোয়ালার কাজ করেন। সকল খরচা মিটায়ে মাস শেষে ভালোই মুনাফা পাচ্ছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান বাজারে গো খাদ্যের প্রচুর দাম বৃদ্ধি। সে তুলনায় দুধের দাম খুব কম। চরম বিপাকে পড়েছেন এই খামার মালিক।
জেয়ালা গ্রামের জাতীয়, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে অসংখ্যবার পুরষ্কার প্রাপ্ত দিবস চন্দ্র ঘোষ দৈনিক জানান, ১৯৯৪ সালে সে গরু বিক্রি করে ১টি বিদেশী গরু ক্রয় করেন। বর্তমানে তার খামারে ৫৫-৬০টি বিদেশী গাভী (গরু) আছে। নিজেই দুগ্ধ দহন করেন। গাভী পালনের জন্য কাজের লোক থাকলেও, গাভীর দুধ দহনে তিনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। নিজের কাজ নিয়ে করতে ভালোবাসেন, এখনও তিনি সকালে ও বিকালে ২৫হতে ৩০টি গাভীর দুধ দহন করেন। প্রতিটি গাভী হতে ১০ হতে ২০ কেজি পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।
একাধিক খামারি বলেন, করোনা সংক্রমণ এর কারনে লকডাউন থাকায় তারা দুধ বিক্রি করতে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন। এছাড়া এবছর গো খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরবরাহ ধারাবাহিকভাবে পারছেন না। সরকারী ভাবে সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তারা জানান।
খামারীরা আরো বলেন, আমাদের এলাকায় দিন দিন বাড়ছে খামার। সাথে সাথে পরিবেশন ভারসাম্য বজায় রাখতে স্থানীয় সরকার সহ সরকার কে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রাখার সহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তালা সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও তালা প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক এসএম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানান, তিনি ইউপি চেয়ারম্যান থাকা কালীন জেয়ালা গ্রাম কে স্থানীয় সরকার প্রধান হিসেবে সকল সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
রেজাউল করিম / একটিভ নিউজ
আপনার মতামত লিখুন :