বাঁশ এমন একটি উদ্ভিদ যা মানবসভ্যতার এক উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা কাজে দরকার পড়ে এই উদ্ভিদের ও তা দিয়ে তৈরি সামগ্রী।
আদিকাল থেকে বাঁশের ব্যবহার বহুমাত্রিক। গ্রামীণ জনপদে একসময় বাঁশঝাড় ছিল না এমনটা কল্পনাও করা যেতো না। যেখানে গ্রাম সেখানে বাঁশঝাড় এমনটিই ছিল স্বাভাবিক। মানুষের জীবনে বাঁশের প্রয়োজনীয়তা যে কতটা, তা বলেও শেষ করা যাবে না। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড় ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ। কিন্তু বনাঞ্চলের বাইরেও এখন যেভাবে গ্রামীণ বৃক্ষরাজি উজাড় হচ্ছে তাতে হারিয়ে যাচ্ছে এ জাতীয় অজস্র গাছপালা।
বাংলাদেশের জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প। মানবজীবনে বাঁশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাঁশ মূলত ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। ঘাস জাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে বাঁশই বৃহত্তম। বাঁশ গাছ সাধারণত একত্রে গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। এই বাঁশগুচ্ছকে প্রচলিত বাংলায় ‘বাঁশঝাড়’বলে। এক একটি গুচ্ছে ৭০-৮০টি বাঁশ একত্রে থাকে। বাঁশ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। বাঁশ চিনে না এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। কমবেশি বাংলাদেশের সর্বত্র বাঁশ উৎপন্ন হয়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার সাধারণ তিন ধরনের বাঁশ চোখে পড়ে তার মধ্যে তল্লা বাঁশ, ভাল্কু বাঁশ ও জাভা বাঁশ। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে। নিত্য ব্যবহার্য এই বাঁশ কালক্রমে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে।
বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছাড়াও আদিবাসীদের জীবনাচরণ ও অনুভূতির প্রতীক।
গ্রাম বা শহর উভয় জায়গাতেই বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা রয়েছে অনেক আগে থকে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বাঁশের তৈরি নানান সামগ্রী ব্যবহার করে থাকি। কাঠ ও বেতের পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যবহার হয়ে আসছে। শিশুদের বিভিন্ন খেলনাপাতিও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়ে আসছে। শিশুরা আকাশে ঘুড়ি উড়ায় সেই ঘুড়িও বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি হয়।
বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তার মধ্যে বাঁশ অন্যতম। বাংলাদেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার হয় না। বাঁশ দিয়ে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ঝুড়ি, ঝাকা, চালুনী, খাঁচা, কুলা, হাতপাখা, ইত্যাদি।
বাঁশের দোচালা ও চারচালা ঘর; বাড়ি-ঘরের বেড়া, ঘরের খুঁটি, ঘরের ঝাপ, বেলকি, কার, দরমা বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। বাঁশ কোন ফলজ বৃক্ষ নয়, ফল ও ফুলের জন্য তার কোন সুনাম-সুখ্যাতি নাই।
মানবসভ্যতার এক উদাহরণ হিসেবে বাঁশের তৈরি পারিবারিক ব্যবহার সামগ্রী তৈরির কাজে সাধারণ ঋষি মশায়রা বেশি দক্ষ। তারা প্রাচীন কাল থেকেই বাঁশের তৈরি নানা সামগ্রী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তালা উপজেলার আঠারোই, ধুলান্ডা ও শাহাদাত পুর ঋষি পাড়ায় কয়েকটি পরিবার এখন সীমিত পরিসরে বাঁশ দিয়ে তৈরি করতে দেখা গেছে নানা সামগ্রী। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্লাষ্টিক ব্যবহারে চাহিদা কমে গেছে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের।
তালা উপজেলার আঠারোই গ্রামের জনোকি দাশ ও মন্টু রায় জানান, এই শিল্প ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সরকারী সহায়তা। তিনি আরো জানান, একটি লোক দিনে ছয় সাত টি ঝুঁকি তৈরি করা যায়, প্রতিটি ঝুঁকি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বিক্রি হয় । একটি ৮০ টাকার বাঁশে তিনটি ঝুড়ি তৈরি করা যায়। মুজুরী ধরলে কোন লাভ নেই।
তবে তারা শুধুমাত্র তাদের পেশাটি ধরে রেখেছেন বলে তিনি জানান। আঠারোই ঋষি পাড়ায় প্রায় দেড় শ' পরিবারের মধ্যে মাত্র ৮-১০ টি পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে। বাকীরা সবাই নানা পেশার বেঁচে নিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :